ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিনে ভাইফোঁটার ছড়া বলা ও নিয়ম পালন - Bhai Dooj in Bengal
বাঙালী, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই থাকুন না কেন, ব্রত, পালাপার্বণ অর্থাৎ বঙ্গ সংস্কৃতির কিছু না কিছু মেনেই চলেন। যেমন বিজয়া দশমীর কোলাকুলি বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় ভাই ফোঁটা ইত্যাদি। বাড়িতে পূজাপার্বণ না করলেও জামাইষষ্ঠী, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া প্রভৃতি সামাজিক নির্দোষ পার্বণগুলোতে লোকলৌকিকতা সকলের বাড়িতে চলতেই থাকে।
'ভাই-ফোঁটা' সম্পর্কে বাঙালী সমাজের কাছে খুব বেশ কিছু বলবার দরকার হবে বলেতো আমার মনে হয় না, বিজয়া, ভাইফোঁটা, ছোটখাটো পারিবারিক অনুষ্ঠান, এরাই এখন সম্পর্কর সুতো। বাঙালি হিন্দু সমাজে যে কটি সামাজিক উৎসবের চল রয়েছে, তার মধ্যে বোধকরি সর্বোত্তম হল ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। চলতি কথায় যাকে আমরা বলি ভাইফোঁটা। ভ্রাতা-ভগিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ এই ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, যে উৎসবের স্নিগ্ধতা বাস্তবিকই অতুলনীয়। ভাই-বোনের প্রীতি-মধুর সম্পর্ক নিয়ে এমন উৎসবের সন্ধান সচরাচর মিলবে না। ভাইফোঁটায় বোন অথবা দিদি যেই হোক, দাদা কিংবা ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে তার দীর্ঘজীবন কামনা করে ছড়া আবৃত্তি করে । এর সঙ্গে নেপালীদের "তিহার" উৎসবের একটা বেশ মিল আছে। ভাই-বোনের যে মধুর সম্পর্ক তাকে ভিত্তি করে ভারতের অন্যান্য জায়গায়ও ভাইটিকা, ভাইদুজ, ভাউবীজ, যমদ্বিতীয়া বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার উৎসব চালু আছে। আপাততঃ আমাদের বাংলার 'ভাই-ফোটা' উৎসব সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক।
কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিকেই বলা হয় ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাই-দ্বিতীয়া। পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে আবার ভাইফোঁটা 'যমদ্বিতীয়া' নামেও প্রচলিত । লোকশ্রুতি অনুসারে যমরাজের ভগ্নী যমুনা এই বিশেষ দিনে যমরাজকে ভাই-ফোঁটা দিয়েছিলেন । সেই থেকেই এই প্রথাটির প্রচলন। এর ছড়ার ভিতরও এর যেন একটু আভাস মেলে। এই দিন ভোর থেকেই প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে বোনেদের ভিতর সাজ সাজ রব পড়ে যায়। কেউ কেউ এই দিনে ভাইকে কি খাওয়াবে সেই নিয়ে আগে থেকেই জল্পনা-কল্পনা শুরু করে, তার ব্যবস্থার জন্যে আগেই প্রস্তুতও হয়। কেউ কেউ যতক্ষণ না ভাইয়ের কপালে, ফোঁটা দেওয়া হয় ততক্ষণ জলস্পর্শও করেনা। কোথাও সকালে কোথাও বা প্রদোষে (সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে) ভাই-ফোটা দেবার প্রথা আছে। অনেকের ভিতর আবার ভাই-ফোঁটায় বারদোষ দেখেও সে বছর ভাই ফোঁটা বন্ধ থাকে। তাদের শনি-মঙ্গলবার ভাই ফোঁটা পড়লে তারা ফোঁটা দেয়না, শুধু ভাইয়ের হাতে খাবারের থালা তুলে অনেকেই খাবারের সঙ্গে ভাইকে নতুন জামা কাপড় দিয়ে থাকে।
অনুষ্ঠানটি ভাইদের জন্য, বোনরা একটি জমকালো ভোজ খাওয়াবে তবে এটাও আবশ্যক যে ভাই এবং বোন উভয়ের বয়স ৫ বছরের বেশি হতে হবে । ভাইরাও বোনদের জন্যে উপহার আর প্রশংসার বন্যা নিয়ে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে অনুষ্ঠানটির জন্য অপেক্ষা করে । যার যেমন সাধ্য, সে সেই ভাবেই ভাইকে ফোঁটা দেয়। তাদের বিশ্বাস এই দিন এই ছড়া বলে ভাইকে চন্দন তিলক পরিয়ে দিলে ভাইয়ের পরমায়ু বৃদ্ধি হয়। সকালে বা সন্ধ্যায় যখনই হোক না কেন, ভাইকে বসান হয় পিঁড়ি অথবা কোনো আসনের উপর। তার সামনে জ্বালিয়ে দেয় প্রদীপ, আর সুমুখে থাকে একখানা বাটা, তাতে থাকে ধান, দুর্বা প্রভৃতি। এরই পাশে থাকে এক থালা (যার যেমন সাধ্য) মিষ্টি সামগ্রী। ভাই প্রথমে বোনের দেওয়া নতুন কাপড় পরে বসে এসে পিঁড়ি বা ব্রত অনুষ্ঠান আসনের উপর। বোন পানের বোটায় করে কাজল পরিয়ে দেয় ভাইয়ের চোখে, তারপর বা হাতের কনিষ্ঠা অঙ্গুলীর সাহায্যে চন্দন নিয়ে ভাইয়ের কপালে পরিয়ে দিতে দিতে মন্ত্র বা ছড়া বলতে থাকে :-
"প্রতিপদে দিয়ে ফোঁটা,
দ্বিতীয়াতে নিতে,"
আজ হতে ভাই আমার, যমের ঘরে
নিমের অধিক তিতে।
ঢাক বাজে, ঢোল বাজে, আরও বাজে কাড়া,
বোনের ফোঁটা না নিয়ে ভাই,
না যেও ঘম পাড়া
না যেও ঘুমের ঘর,
আজ হতে ভাই আমার রাজ রাজেশ্বর।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দেই আমার ভাইর কপালে ফোঁটা।
ভাইর কপালে দিলুম ফোটা,
যম দুয়ারে পড়লো কাটা ।।
তিনবার চন্দন সহ এই শ্লোক (ছড়া) বলে ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেয় বোন, আর প্রতিবার শ্লোক (ছড়া) বলা শেষ হলে ঐ কনিষ্ঠা অঙ্গুলী দ্বারা মাটিতে একটি করে কাটা 'x' চিহ্ন এঁকে দেয়। তারপর বোন ছোট হলে ভাইকে কিংবা ভাই ছোট হলে বোনকে করে প্রণাম এবং মিষ্টির থালা তুলে দেয় ভাইয়ের হাতে, আর ভাই বড় হলে বোনকে, কিংবা বোন বড় হলে ভাইকে ধান দূর্বা দিয়ে করে আশীর্বাদ।
যমপুকুর ব্রত ছাড়া বাংলার আরেকটি যে পার্বণের মধ্যে যমের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি আছে, তা হল ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃ-দ্বিতীয়া। একে আদিরূপে যমদ্বিতীয়া বলে অভিহিত করা হত। কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিটি এই ভাইফোঁটার জন্য নির্ধারিত | স্মরণীয়, যমপুকুর ব্রতে যমের তুষ্টি বিধানের জন্যও কার্তিক মাসটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে । কথিত আছে যে, যমরাজার বোন যমুনা এই বিশেষ দিনে যমরাজাকে ফোঁটা দিয়েছিলেন। এবং সেইজন্যই ভাইফোঁটা নাকি যমরাজকে প্রীত করে। ভাইদের যমভয় থেকে উদ্ধার পাবার জন্য বোনেরা এই ব্রত পালন করেন।
ভাইয়ের সামনে মিষ্টির থালা, পান-বাতাসা রেখে প্রদীপ জ্বালানো হয়। বিশেষভাবে একটি হস্তমুদ্রা তৈরি করে বাঁ-হাতের কড়ে আঙুল বা অনামিকার সাহায্যে দই-চন্দন, মতান্তরে ঘি-চন্দন এবং কাজলের ফোঁটা তিনবার কপালে ঠেকানো হয়। এই সময় একটি ছড়া মন্ত্রের আকারে ব্রতিনী উচ্চারণ করেন। পাশাপাশি মাটিতেও তিনবার 'x' চিহ্ন আঁকা হয়। পরিশেষে ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ ও প্রণামের পর্ব সারা হয়। যে ছড়াটি বলা হয়, অঞ্চলভেদে তার মধ্যে কিছু কিছু রূপান্তর নজরে পড়ে। যেমন :
"দ্বিতীয়াতে দিয়া ফোঁটা
তৃতীয়াতে নিয়া নিতা,"
যমুনা দেয় যমেরে ফোঁটা,
আমি দিই আমার ভাইরে ফোঁটা,
আজ অবধি ভাইয়ের আমার—
যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা ৷
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যমদুয়ারে পড়ল কাটা,
ভাই আমার সোনার ডাঁটা
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা,
যম যেমন অমর-
আমার ভাই যেন হয় তেমনি অমর।
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
যম দুয়ারে পড়লো কাটা
ফোঁটা যেন নড়ে না, ভাই যেন মরে না ।
এই ব্রতটির কোনো কথা-অংশ পাওয়া যায় না। [হয়ত আদিতে ছিল।] লক্ষণীয় যে, ছড়াগুলির মধ্যে সর্বত্রই যম এবং তার বোনের প্রসঙ্গ আসছে। ঋগ্বেদে যম এবং তার বোন যমীর উল্লেখ পাওয়া যায়; ভাইফোঁটার ছড়ায় যমের বোন হলেন যমুনা। 'পরবর্তীকালে হিন্দু পুরাণে যমীকে আর বিশেষ দেখা যায় না। শুধু মার্কণ্ডেয়পুরাণে উল্লেখ আছে |
সেধে কে আর যমের সান্নিধ্য প্রার্থনা করে? অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে। মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ ব্যতিরেকে যাদের দ্বিতীয় কোনো মুক্তির পথ রুদ্ধ।
ব্রতের ছড়াতে যমের উপস্থিতি না ঘটলেও যমকে প্রসন্ন করার প্রয়াস লক্ষণীয়। যমপুকুর ব্রত তারই নিদর্শন। আসলে এ হল যমরাজা ও যমরানীর পূজা। এতে যে ছড়াটি বলা হয় তা অবশ্য যম-প্রসঙ্গ বিমুক্ত :
শুনি কলমি ল ল করে,
রাজার বেটা পাখি মারে।
মারণ পাখি সুখোর বিল,
সোনার কৌটা প্রপার খিল।
খিল খুলতে লাগল ঘড়
আমার বাপ ভাই হোক লঙ্কেশ্বর ।
আমরা জানি পাণ্ডুর প্রথম পুত্রসন্তান যুধিষ্ঠির। যুধিষ্ঠির জননী কুন্তী ও ধর্মের ঔরসে গর্ভধারণ। তাহলে যুধিষ্ঠির যমপুত্র এবং কুন্তীর গর্ভজাত। সূর্যের সন্তান যম । আবার সূর্যের পুত্র কর্ণ কুন্তীর গর্ভে জন্ম । যুধিষ্ঠির ও কর্ণ উভয়েরই জন্ম কুন্তীর গর্ভে।
এ এক ধাঁধা -
যমরাজ মন্ত্রীর নাম কি সে হয়,
পাপ পুণ্যের হিসাব যার কাছে রয়। | চিত্রগুপ্ত]
ভাইফোঁটা হিন্দুদের কাছে খুবই জনপ্রিয় একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান। হিন্দু পুরাণ মতে, নরকাসুর নামে এক ভয়ংকর অসুরকে বধ করার পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বোন সুভদ্রার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সুভদ্রা কপালে তিলক কেটে তাঁকে স্বাগত জানান এবং মিষ্টি খেতে দেন। ফুল দিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। সেই সময় থেকে ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয় বলে মনে করা হয়। কথিত আছে, এই দিনেই মৃত্যুর দেবতা যম তাঁর বোন যমুনার হাতে ফোঁটা নিয়েছিলেন। তাই, ভাইফোঁটায় দিদি বা বোনেরা ভাই বা দাদার দীর্ঘায়ু কামনা করে ছড়া কাটে 'যমুনা যেমন যমকে ফোঁটা দিয়ে অমর করেছিল, আমিও তেমনি আমার ভাইকে ফোঁটা দিয়ে অমর করলাম।' পরিবারের নিজস্ব রীতি মেনে অবশ্য এই ছড়াটির প্রকারভেদ রয়েছে। এই উৎসবের পোশাকি নাম ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। বাঙালি হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, এই উৎসব কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় দিন অনুষ্ঠিত হয়। তবে, পূর্ববঙ্গীয়দের মধ্যে প্রতিপদে শুক্লপক্ষের প্রথম দিন (কালীপুজোর পরের দিন) ভাইফোঁটার চল রয়েছে।
১. যমদ্বিতীয়া কী?
ভাইফোঁটা উৎসবের অপর নাম
২. ভাইবিজ কাকে বলে?
ভাইফোঁটা উৎসবের অপর নাম হরিয়ানা, গুজরাত, মহারাষ্ট্র,
গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে 'ভাইবিজ' বলে
৩. নেপাল ও দার্জিলিংয়ের পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসব কী নামে পরিচিত?
ভাইটিকা
৪. মহারাষ্ট্রে যেসব মেয়েদের ভাই নেই, তারা কাকে ফোঁটা দেয়?
চন্দ্র দেবতাকে ভাই
মনে করে ভাইফোঁটা দেয়
৫. এই উৎসব উপলক্ষে মহারাষ্ট্রে যে বিশেষ ধরনের মিষ্টি তৈরি হয়,তার নাম কী?
মহারাষ্ট্রের মিষ্টি যাকে বলা হয় বাসুন্দি পুরি বা খিরনি পুরি বা শ্রীখণ্ড পুরী
এই উপলক্ষ্যেই বানানো হয় ।
৬. রীতি অনুযায়ী কোথায় ভাইয়েরা বোনেদের হাতে কাপড় মোড়া বাতাসা তুলে দেন?
উত্তরপ্রদেশে
৭. কোথায় ভাইদের প্রথমে তেঁতো ফল খাওয়ানো হয়?
এই ফলের নাম কী? মহারাষ্ট্রে, ফলটির নাম করিথ
৮. বিহারে এই উৎসবকে ঘিরে কী অদ্ভূত নিয়ম চালু রয়েছে?
আর্শীবাদের বদলে বোনেরা
ভাইদের গালাগালি ও অভিশাপ দেন, তারপর জিভে বুনো জাতীয় কাঁটাফল বিধিয়ে
প্রায়শ্চিত্ত করেন
৯. ভাইফোঁটার জন্য কি কি লাগে
o ভাইফোঁটা দেবার সমস্ত সামগ্রী রাখার জন্যে ধাতব থালা, কাঁসা বা পিতলের না থাকলে স্টিলের থালা ।
o ভাইফোঁটা দেবার সময় বা নেবার কাঠের পিড়ি বা আসন ।
o ধুপ ও ধূপদানি ।
o শঙ্খ, এই সময় শঙ্খ বাজানো হয় এবং বাঙালিরা উলুধ্বনি করেন ।
o ফোঁটা দেওয়া বা নেওয়ার সময় অবশ্যই পরিষ্কার কাপড় পরে নিতে হবে ।
o ধান এবং দুর্বা ঘাসের শীষ আশীর্বাদের জন্যে ।
o চন্দন, দই, কাজল, ঘি, মধু ফোঁটার জন্যে । প্রতিটা ছুঁয়ে তিনবার কপালে ফোটা দিতে হবে পাশাপাশি তিনবার মাটিতেও কাটা 'x' চিহ্ন আঁকা হয় ।
o প্রদীপ, সলতে ও গোটা পান পাতা, তাপে গরম করে ভাইয়ের মুখে বোলানোর জন্যে ।
o মিষ্টি, জলের গ্লাস ও উপহার সামগ্রী ।
পশ্চিমবঙ্গের সব জেলাতেই ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় পালিত হয় ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া ব্ৰতানুষ্ঠান । দার্জ্জিলিং জেলার নেপালী নারীরা দুবার ভাইফোঁটা দেয় । ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন প্রথম একবার ভাইফোঁটা দেয় এবং দ্বিতীয়বার ভাইফোঁটা দেয় 'তিহার' উৎসবের সময়। নেপালীরা একে বলে 'ভাইটিকা'। কিজা পূজা একটি ঐতিহ্যবাহী নেওয়ারি অনুষ্ঠান । নেপালে, যেখানে এটি দশাইনের (বিজয়া দশমী / দশেরা) পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। তিহার উৎসবের পঞ্চম দিনে পালন করা হয়, এটি নেপালের মৈথিলদের দ্বারা ব্যাপকভাবে পালিত হয় ভার্দুতিয়া ভাই টিকা হিসাবে এবং মাধেসিদের ও অন্যান্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা অনুসরণ করে। যদিও নেওয়ারিরা এটিকে কিজা পূজা হিসেবে পালন করে। বোনেরা তাদের ভাইয়ের কপালে সপ্তরঙ্গী টিকা নামে পরিচিত সাত রঙের একটি লম্বাটে টিকা দেয় । উত্তর প্রদেশ এবং বিহারের আওধ এবং পূর্বাঞ্চল অঞ্চলে এটি ভাইয়া দুজ নামেও পরিচিত। এটি নেপাল এবং বিহারের মৈথিলদের ও ভার্দুতিয়া এবং অন্যান্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা ব্যাপকভাবে উদযাপন করে। দিওয়ালিতে নববর্ষ পালন করে এবং নববর্ষের প্রথম দিনটি গোবর্ধন পূজা হিসেবে পালন করা হয়।
ভাই জিন্তিয়া (ওড়িয়া: ଭାଇ ଜିଉନ୍ତିଆ) শুধুমাত্র পশ্চিম ওড়িশায়। মহারাষ্ট্র, গোয়া, গুজরাট এবং কর্ণাটক রাজ্যের মারাঠি, গুজরাটি এবং কোঙ্কানি-ভাষী সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাউবীজ, বা ভববিজ (মারাঠি: भाऊ बीज) বা ভাইবীজ। অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানায় ভাগিনী হস্ত ভোজনামু। হিন্দু ধর্ম অনুসারে, দুষ্ট রাক্ষস নরকাসুরকে বধ করার পর, ভগবান কৃষ্ণ তার বোন সুভদ্রার সাথে দেখা করেছিলেন তখন সুভদ্রা তাকে মিষ্টি এবং ফুল দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা করেছিলেন এবং স্নেহের সাথে কৃষ্ণের কপালে তিলক লাগালেন। কেউ কেউ এটাকে উৎসবের উৎপত্তি বলে মনে করেন।
যেহেতু হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্রে ভাউ-বীজের উদযাপনের প্রথা রয়েছে, যে সমস্ত মহিলার ভাই নেই তারা পরিবর্তে চন্দ্রের পূজা করে। তারা তাদের ঐতিহ্য হিসেবে মেয়েরা মেহেদি লাগায়। যে বোনের ভাই তার থেকে অনেক দূরে থাকে এবং তার বাড়িতে যেতে পারে না, চাঁদ দেবতার মাধ্যমে তার ভাইয়ের দীর্ঘ এবং সুখী জীবনের জন্য আন্তরিক প্রার্থনা পাঠায়। তিনি চাঁদের আরতি করেন। এই কারণেই হিন্দু পিতামাতার সন্তানরা স্নেহের সাথে চাঁদকে চাঁদমামা বলে ডাকে (চান্দা মানে চাঁদ এবং মা মানে মায়ের ভাই)।
সেকালের ভাইফোঁটা
চারু কাপড় ছাড়িয়া দূর্বা তুলিতে গেল। ফলবাগানে চামেলী গাছের জাফরীর কাছে বেশ বড় বড় সুন্দর দূর্বা জন্মিয়াছিল; চারু, কতকগুলি দূর্বা তুলিয়া সেগুলি ধাইয়া একখানি রেকাবীতে রাখিল। তাহার পর চন্দনপাটা পাড়িয়া খানিক চন্দন ঘষিল। ধান দূর্বা ও চন্দনে রেকাবখানি সাজান হইলে, চারুবালা পিসীকে ডাকিয়া আনিবার জন্য লক্ষ্মীকে বামার বাড়ী পাঠাইয়া দিল। ভ্রাতৃদ্বিতীয়াতে ক্রয় বিক্রয়ের কিছু ধুমধাম আছে বলিয়া আজ খুব সকালেই বাজার বসিয়াছে।
বামা পানের দোকানে গিয়া বাছিয়া বাছিয়া এক পণ ঝাড়া পান কিনিল; কিন্তু এক পণ পান কিনিতে তাহাকে দেড় পণ কথা খরচ করিতে হইল। বারুই ভারি 'বেচাল', পানের গোছার উপরে ও নীচে দুই দশটা বড় পান দিয়া ভিতরে 'কুলের পাতার মত' ছোট ছোট পান পারিয়া দিয়াছে। বামাকে ফাঁকি দিবার চেষ্টা! বামা পানের গোছা খুলিয়া ফেলিল, এবং বাছিয়া বাছিয়া ছোট পানগুলি বাহির করিয়া ফেরত দিল; নিজের হাতে বড় বড় পান বাছিয়া লইল, বামা কেমন পদার্থ, তাহা গোবিন্দপারে কাহারও অজ্ঞাত ছিল না। ভাতৃদ্বিতীয়া উপলক্ষে ময়রার দোকানে নুতন খেজুর গুড়ের সন্দেশ, ছাপার সন্দেশ, রথ হাতী, পাখী, বিড়াল, মাছ প্রভৃতির ছাঁচ এছাড়া নিমকি, কাশী খাজাও উঠিয়া থাকে। এই খাজা অত্যন্ত মুচমুচে, এবং ভাজা তিলে আবৃত। ইহার নাম 'কাসি খাজা' কেন হইল, তাহা জানিতে পারি নাই। বামা এই ছাপা, গোল্লা ও রসগোল্লা প্রভৃতি কয়েক রকম মিষ্টান্ন লইয়া আসিল।
চারু , এতক্ষণ বসিয়া বসিয়া সুপারী কাটিতেছিল। সুপারী কাটা শেষ হইলে সে পান সুপারী, ধনের চাল, এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি প্রভৃতি নানাবিধ মশলা দই-এক মষ্টি দিয়া তিনখানি রেকাবী ও বিবিধ মিষ্টান্ন দিয়া আর তিনখানি রেকাবী সাজাইল; তাহার পর ভাইফোঁটা দিবার জন্য মাঝের ঘরে তিনখানি আসন পাতিল; পরিষ্কার গেলাসে তিন-গেলাস জল রাখিল রেকাব কয়েকখানি বিবিধ মিষ্টান্নে পূর্ণ করিয়া চার, লক্ষ্মীকে বলিল, “লক্ষ্মী, দুই দাদাকে আর যোগীনকে ডেকে আন; আর তুইও কাপড় ছেড়ে আয় : কিছু খাস, টাস, নি তো? তুইও ফোঁটা দিবি।” লক্ষ্মী তাহার আঁচল লুটাইতে লুটাইতে কালো কুঞ্চিত কেশের নিবিড় স্তবক দোলাইতে দোলাইতে, উপেন ও যোগীনকে ডাকিতে গেল। সুরেন সকলের ছোট, তাহার বয়স তিন বৎসর মাত্র, চার, তাহাকে একখানি নীলাম্বরী কাপড় পরাইয়া, গায়ে জামা, পায়ে মোজা পরাইয়া দিল, এবং কেরেপের চাদরখানিতে তাহার গলদেশ বেষ্টন করিয়া, মাথায় নরম পাতলা চুলগগুলির মধ্যে একটি সিথি কাটিয়া, তাহাকে একখানি আসনের উপর বসাইয়া দিল। উপেন ও যোগীন কাপড় চোপড় পরিয়া ভদ্রলোকের মত হইয়া আসনের উপর বসিল। তাহাদের দেখাদেখি সুরেনও কোন প্রকার অস্থিরতা প্রকাশ করিল না, অত্যন্ত গম্ভীরভাবে রেকাবীর উপর সজ্জিত স্তূপাকার সন্দেশের দিকে লম্বা দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিল !
চারু প্রথমে বামহস্তে রেকাব হইতে ধান দূর্বা তুলিয়া তিনবার তাহার দাদার মাথার উপর দিল, এবং বামহস্তের কনিষ্ঠাঙ্গালি দিয়া চন্দন লইয়া দাদার কপালে "তিনবার তাহা স্পষ্ট করিল, তাহার পর মশলা, পান ও সন্দেশে পূর্ণ দুখানি রেকাবী দাদার উভয় হস্তে স্থাপন করিয়া নতমস্তকে ভূমিস্পর্শ করিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল। অনন্তর চারু ছোট ভাই দুটির কপালে ফোঁটা দিল। যোগীন চারুকে প্রণাম করিল দেখিয়া, সুরেনও দিদির পায়ের কাছে মাথা লুটাইল এইবার লক্ষণীর ফোঁটা দিবার পালা। দিদির দেখাদেখি লক্ষ্মীও ভাইফোঁটা দিল। চারু, হাসিয়া বলিল, "লক্ষ্মী তুই দাদাকে ফোঁটা দিলি, ভাইফোঁটার মন্তর বলেছিস্ ?" লক্ষ্মী দিদির দিকে মুখ তুলিয়া তাহার চক্ষুর উপর কৌতহলপূর্ণ দৃষ্টি সংস্থাপিত করিয়া বলিল, "কোন মন্তর দিদি ? তুই ত মন্তর বলিস্ নি !" চারু হাসিয়া বলিল, "মন্তর কি চেচিয়ে বলে? মন্তর মনে মনে বলতে হয় ; সেই যে তোকে বলেছিলাম, 'ভায়ের কপালে - " লক্ষ্মী হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, "হ্যাঁ হ্যাঁ মনে হয়েছে,— 'ভায়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা।"
এমন সময় ঠাকুরদাদা মহাশয় চলে আসিলেন - দাদামহাশয় নাতিনী-সম্ভাষণ পরিত্যাগ করিয়া বাজারে চলিলেন। আজ বাজারে নানাপ্রকার জিনিসের আমদানী হইয়াছে। দাদামহাশয় বাজারের মধ্যে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ভাল মাছ, পটোল, বেগুন, লাল আলু, প্রভৃতি তরকারী কিনিলেন। বাজারে সকল তরকারী কিনিতেও হইল না, বুনো-বাড়ী হইতে লাউ ও সুয্যিকুমড়ো আনাইয়া লওয়া হইল। পালঙ্, শাক, শিম ঘরের বাগানেই যথেষ্ট ছিল। নানারকম তরকারী, ডাল, মাছ, মুড়িঘণ্ট, তিলপিটিলি বেগুন্ ভাজা, লাল-আলুর গুড় -অম্বল, নলেন গুড়ের পায়েস, দেখিতে দেখিতে একটা ভোজের আয়োজন হইল! মুড়িঘণ্ট ও পায়েস চারুর মা রাঁধিলেন : মাছ, কলায়ের ডাল ও দুই তিনখানি তরকারী চারু নিজে রাঁধিল ; বিধবা পিসীমা নিরামিষ তরকারী, শুক্তানি গুড়-অম্বলে সিদ্ধহস্ত সেগুলি তিনিই রাধিয়া দিলেন।
more storiesদাদামহাশয় নাতি-নাতিনীদের সঙ্গে লইয়া আহারে বসিলেন। তিনি কলায়ের ডাল খাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "চারু ডালটা কে রেধেছে রে? অনেক দিন এমন চমৎকার ডাল খাইনি।" চারু আড়াল হইতে মুখ বাহির করিয়া দাদামহাশয়ের পাতের উপর হাস্যোজ্জ্বল কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, "রান্না ভাল হয়নি ব'লে বুঝি ঠাট্টা হচ্ছে! ঠাকুমার মত রান্না শিখতে পারিনি ব'লে এত ঠাট্টা কেন দাদামশায় ? ঠাকুমার যদি একবার দেখা পাই ত রান্নাটা তাঁর কাছ থেকে ভাল করে শিখে নিই।" দাদামহাশয় হাসিয়া বলিলেন, "তোর ঠাকুমা ভালই রাঁধতো বটে, তা তুইও খাসা রাঁধতে শিখেছিস্ ।" সকলে তৃপ্তিসহকারে ভোজন করিলেন। আহারান্তে চারু পান ছেচিয়া একখানি রেকাবীতে করিয়া তাহা দাদামহাশয়ের কাছে আনিয়া দিল।
একালের ভাইফোঁটা
বাঙালি ভোজনরসিক, তাই আমাদের উৎসবগুলিতে উপবাসের থেকে প্রসাদের গুরুত্ব অনেকটাই বেশি। ভাইফোঁটার কথাই যদি ধরি, খাওয়াদাওয়ার পদতালিকায় বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তনের ছোঁওয়া লেগেছে, প্রবেশ করেছে নতুন ভিনদেশি সব পদ। অবশ্য কিছু চিরন্তনী পদ বাঙালির পাতে কালজয়ী, যেমন ফুলকো লুচি। কচুরি, ডালপুরি, রাধাবল্লভী বা বিলিতি স্যান্ডউইচ, প্রতিযোগিতায় কেউই সুবিধে করতে পারেনি লুচির সাথে এই বিশেষ দিনের মেনুতে । গোল গোল সাদা সাদা হাওয়াভরা লুচি বাঙালির খুব প্রয়োজন। লুচির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে ভাজা ছোকা- হেঁচকি-দম ডালনা ছোলার ডাল, এমনকি মাছ মাংসও। "তপ্ত তপ্ত তপসে মাছ গরম গরম লুচি /অজ-মাংস বাঁধাকপি আলু কুচি কুচি।" তবে ভাইফোঁটায় লুচি সকালের জলখাবারের পাতেই চলে। তাই সেখানে নিরামিষের দিকেই পাল্লা ভারী। সকালে লুচির সঙ্গে ছোলার ডাল, কুমড়ো-আলু-পটল-ছোলা দিয়ে ছোকা, বেগুন-পটল ভাজা এগুলোই আগে বেশি দেখা যেত। সাদামাটা মেনুতে লুচির সঙ্গে ভাজাভুজি আর আলুর ছেঁচকি বা সাদা আলুর চচ্চড়ি। দু'ক্ষেত্রেই যোগ্য সঙ্গতে উপস্থিত থাকে মিষ্টির থালা। এক সময়ে গুপ্তিপাড়ার সন্দেশের চাহিদা ছিল খুব। সকালের জলখাবারে লুচির সঙ্গে সাধারণত কড়া পাকের সন্দেশের সঙ্গতই ছিল বেশি। কড়া পাকের মধ্যে বাতাবি, আতা, তালশাঁস প্রভৃতির নাম উল্লেখ্য। নরম পাকের মধ্যে গোলাপি পেড়া, শাঁখ সন্দেশ ভাইফোঁটায় বেশ জনপ্রিয়। পেস্তা বাদাম দেওয়া বাদশাহি চেহারার দিলখুশ বা জাফরানি সন্দেশ, প্যারাডাইস, রোজ ক্রিম, আবার খাব, বাদশাভোগ এই সব।
জলখাবারের এই 'সামান্য' গৌরচন্দ্রিকার পর মধ্যাহ্নে আসে মূল পর্ব। উৎসবের মেনুতে চাই পোলাও, কালিয়া, চাই মাছ মাংস; চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য সব চাই। ভাইফোঁটায় ভাইয়ের পাতে সাধারণত মাছ-মাংস ছাড়া নিরামিষ কাজু-কিশমিশ পোলাওই বেশি জনপ্রিয়। পোলাও-এরই আর একটু সরল রূপ ঘি-ভাত। অনেক সময়ে প্রথম পাতে ঘি দেওয়া সাদা ভাতের সঙ্গে ভাজাভুজি, মাছের মাথা দিয়ে ভাজা মুগের ডাল, মাছের চপ অথবা মাছের পুর ভরা পটলের দোলমা দিয়ে খাওয়া শুরুর পর একে একে পোলাও, চিংড়ির মালাইকারি, মাংসের কালিয়া, এই সব প্রধান অতিথিপদ। কিছু বিশেষ পদেরও কথাও বলা যায়। যেমন, মাছের হরগৌরী বা গঙ্গা-যমুনা। তবে উৎসবের পাতে পোলাও-কালিয়ার প্রতি আসক্তির পাশে মোগলাই ঘরানার বিরিয়ানি, চাঁপ, এদের কিন্তু উনিশ বা বিশ শতকেও ভাইফোঁটার পাতে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি ফ্রায়েড রাইস-চিলি চিকেন রূপে চিনা আগ্রাসনও।
এবার আসি শেষ পাতের গল্পে, বাঙালি সংস্কৃতি হল রসগোল্লা আর সন্দেশের সংস্কৃতি। কোনও কোনও দিন বাঙালি মিষ্টির আর ভরপেট বাঙালি খাবারের কিলো কিলো ক্যালরি নিয়ে কেউ অভিযোগ করবে না । বছরকার দুটি দিন, এক ভাইফোটা আর দুই হলো জামাইষষ্ঠী । ক্যালরি নিয়ে নাক কোঁচকানো গলে যায় এই দুই দিন ছানার পায়েস কিংবা রাবড়ি, রসমালাই বা বেক্ড রসগোল্লা দেখলে । আজকাল আবার চকোলেট সন্দেশের উপরও ভাইফোঁটার ছাপ দেখা যাচ্ছে। ভাইবোনের ছবি লাগিয়ে কেকের চলও শুরু হয়েছে। রসের মিষ্টির মধ্যে রাজভোগ ও কমলাভোগই এখনও বেশি দেখা যায় ভাইফোঁটার পাতে। কেনা মিষ্টির পাশাপাশি ঘরের হেঁশেলের চালের পায়েসকেও ভুললে চলবে না মোটেই।
ভাইফোঁটা উপলক্ষে কোনও কোনও মিষ্টি-বিপণি একযোগে পাঁচ থেকে সাত রকম মিষ্টির খালি বিক্রি করছে। ভবানীপুরের বলরাম ময়রার উত্তরপুরুষ সুদীপ মল্লিক বলছিলেন, "ভাইফোঁটায় মিষ্টির থালির জোর চাহিদা। খাজা, গজা, ভাইফোঁটা ছাপ সন্দেশ, চিত্রকূটের সঙ্গে হয়তো নোনতা পদ্ম নিমকি থাকবে। সাত রকমের আইটেম থাকলে দু-একটা নতুন মিষ্টি ঢুকবে।" মিষ্টির এই থালি বা এখন ভাইফোঁটার ডালা-সংস্কৃতিতে নেমে পড়েছে রিষড়ার ফেলু ময়রাও। পাঁচ, সাত কী এগারো রকমের মিষ্টি সাজিয়ে দিচ্ছে তারা। বলরামে মেলামাইনের 'আনব্রেকেবল' থালায় মিষ্টির প্যাকিং হলে ফেলু ময়রায় দস্তুর মাটির বা প্লাস্টিকের থালা। সেখানকার অন্যতম কর্ণধার অমিতাভ "ভাইফোঁটার" মোদক বলছেন, ঐতিহ্যমাফিক খাজা, চিত্রকূট, লবঙ্গলতিকার সঙ্গে নলেন গুড় বা আমের মোহিনী সন্দেশ, সীতাভোগ, রাজভোগ, মালাই চমচম, ক্ষীরের প্যাটি থেকে উত্তর ভারতীয় ঘরানার পেস্তা কাজু বরফি, রাবড়ি পর্যন্ত থাকছে মিষ্টির সম্ভারে। দূরে থাকা ভাইবোনেদের মিষ্টি পাঠানোর বড়োই দায়। ফলে ভাইফোঁটা এখন আর মোটেই দু'-এক দিনের ঝোড়ো কাউন্টার সেল নয়, দূরের ভাইবোনেদের মিষ্টি পাঠানোর কারবার চালু হয়ে যায় কালীপুজোর ক'দিন আগেই।
প্রবাসীরা অনেকেই পুজোর পরে মন খারাপ নিয়ে স্বধামে ফেরেন। কয়েকটি মিষ্টির দোকান এখন, একেলে প্যাকিংয়ে আঁটোসাঁটো করে তাঁদের উড়ানে বয়ে বেড়ানোর জন্য পছন্দসই মিষ্টি বেঁধেছেদে দেয়। ভাইফোঁটা উপলক্ষে মিষ্টি সরবরাহের প্রস্তুতি চলতে থাকে টানা চার-পাঁচ দিন ধরে। এখনও বাঙালি ময়রার নতুন মিষ্টি নিয়ে নিরীক্ষা ভাইফোটার দিনটিকেই জড়িয়ে থাকে। কাঠবাদাম, কেশর-পেস্তা যোগে 'বাদামি' বলে একটি সন্দেশ চালু করেছে নকুড়। সঙ্গে আমের শাঁস ভরপুর, ঠান্ডা-ঠান্ডা ম্যাঙ্গো বাটি। কে সি দাশ পেশ করছে স্ট্রবেরি ছানার পায়েস, শাহি টুকরা অনুপ্রাণিত নবশ্রী। বলরাম টেক্কা দিয়েছে মিহি পাক কফি সন্দেশ, ডাব সন্দেশ, আঞ্জির সন্দেশ, এক ধরনের নলেন গুড়ের পুডিংয়ে। ফেলু ময়রাও হেজেলনাট সমৃদ্ধ নতুন সন্দেশ এনেছে। বরাবরের মতো ফর্দ মিলিয়ে ভাইফোঁটায় মিষ্টির বাজার দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে, ভাইফোঁটার পার্বণ তারই সাক্ষী।
দেখা হয় নাই - ভাইফোঁটা মেলা
নদীয়ার বিরহী-বাজারে পিচের রাস্তার দু'পাশে সামান্য কয়েকটি দোকানপাট। কাছাকাছি হাটও বসে হাট-বারে। আর কিছু ছড়ানো-ছিটানো কুড়েঘর নিয়ে ছোট গ্রাম। আপাতদৃষ্টিতে কোনই বিশেষত্ব নেই। বিরহী-বাজারের কাছ থেকে বার হয়ে পিচের এক শাখা-সড়ক তিন মাইল পরে, শিয়ালদহ- রাণাঘাট রেলপথের মদনপুর (কল্যাণীর পরবর্তী স্টেশন) অবধি গিয়েছে। সেপথে সিকি মাইলটাক গেলে, মজা নদী যমুনার ধারে অনেকখানি খোলা জায়গা চোখে পড়ে। সেখানে অতি প্রাচীন বট-অশ্বথের ছায়ার পাতলা ইটের তৈরি এক ঘাট ও অদূরের এক দালান-মন্দিরে উপাসিত রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহকে ঘিরেই বিরহীর যা কিছু বৈশিষ্ট্য। মন্দিরটি যে প্রায় দুশ বছর আগে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলেই স্থাপিত হয়েছিল এমন অনুমান লাভ বলেই মনে হয়।
মুখোপাধ্যায় উপাধিধারী বর্তমান পুরোহিত বংশ নিত্যপুজো অব্যাহত রেখেছেন কোনোগতিকে | সামান্য কিছু বার্ষিক সাহায্য পাওয়া যায় ভাইফোঁটার সময়। তখন এক বিশেষ উৎসব হয় এ মন্দিরে। সামনের খোলা মাঠে বড়গোছের এক মেলাও বসে।
সে এক আশ্চর্য মেলা। ভাইফোঁটা উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের আর কোথাও কোন মেলা হবার কথা আমি শুনিনি। সমাগত যাত্রীদের মধ্যে পরষের থেকে স্ত্রীলোকের সংখ্যাই যে সাধারণত বেশী হয় সেটাও এক বিস্ময়কর ব্যাপার। গ্রামাঞ্চলে পুজাপার্বণ ও মেলায় মহিলারা পর্দাপ্রথা বড় একটা মানেন না; ক্ষণস্থায়ী উৎসবে কাতারে কাতারে এসে উপস্থিত হন। কিন্তু বিরহীর এই মেলায় যেন প্রমীলার রাজত্ব। এত বিশাল মহিলা সমাবেশ পাড়াগাঁয়ে বড় একটা দেখা যায় না। মেলার আনন্দে অংশ গ্রহণ করা তাঁদের গৌণ উদ্দেশ্য হলেও আসল অভিপ্রায় ভাইফোঁটা উপলক্ষে মদনগোপালের কপালে বা তাঁর উদ্দেশে ফোঁটা দেওয়া। মর্ত্যের মানবীরা যে স্বর্গের দেবতাকে এভাবে ভ্রাতৃত্বে বরণ করে নেন, এ আশ্চর্য-সূন্দর প্রথা নাকি বহুকালের। স্থানীয় লোকেরা মনে করেন মন্দির প্রতিষ্ঠার কাল থেকেই—অর্থাৎ প্রায় দুশ বছর ধরে-এ রীতি চলে আসছে। যে কোন মহিলাই কিন্তু ফোঁটা দেবার অধিকারী নন। যাঁদের সহোদর ভাই নেই বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন অনুপস্থিত, তাঁরাই দলে দলে আসেন চারপাশের গ্রাম থেকে। কৃষ্ণ তাঁদের কাছে স্বর্গলোকবাসী প্রবলপ্রতাপ দেবতা নন, আদরের ভাই। প্রিয়কে দেবতা ও দেবতাকে প্রিয় করবার এ এক অভিনব লৌকিক দৃষ্টান্ত।
সাধকেরা তাঁদের আরাধ্যা দেবীকে কখনও বলেছেন মা, কখনও বলেছেন 'মেয়ে', কিন্তু ভাইফোঁটার দিন একটা গোটা নারীসমাজ তাঁদের আত্মীয়তার উত্তাপে অভিষিক্ত করে যান বিরহীর মদনগোপালকে। সকলেই যে মন্দিরে ঢুকে কৃষ্ণের কপালে ফোঁটা দিতে পারেন তা নয়। অরাহ্মণ মহিলারা তেল, হলুদ ও সিদুর মেশানো ফোঁটা দেন ঠাকুরঘরে প্রবেশপথের দু'পাশের দেওয়ালে। কৃষ্ণ-ভাইয়ের উদ্দেশে নিবেদিত অগণিত ফোটায় সে দেওয়াল আচ্ছন্ন। বিরহী নামের উৎপত্তির ব্যাখ্যা কি স্থানীয় কিংবদন্তী অনুসারে, সেখানকার মদনগোপাল নাকি আদিতে এককভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, সঙ্গে কোন রাধিকা-মূর্তি ছিল না। রাধিকার জন্য কৃষ্ণের বিরহ ও তার নিরসনের এ কাহিনীকে অবলম্বন করেই নাকি গ্রামের নাম হয় বিরহ। কিন্তু কৃষ্ণকে ভ্রাতৃভাবে উপাসনা করবার যে রীতি এ অঞ্চলের মহিলামহলে প্রায় দুই শতাব্দী ধরে প্রচলিত তার সঙ্গে এ জনশ্রুতির কোন সম্পর্ক নই।
মহামহিমান্বিত দেবতাকে দূর স্বর্গলোকে নির্বাসন না দিয়ে তাঁর এই অন্তরবেদনা উপলব্ধি করে তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। তারপরে যে প্রথার তিনি সূত্রপাত করেন, কালক্রমে তা বহু-পল্লবিত হয়ে এখন এক বার্ষিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। সহোদরার স্নেহপ্রীতি থেকে আজীবন বঞ্চিত কৃষ্ণের এক নিভৃত তৃষ্ণা মিটিয়েছেন এ অঞ্চলের নারীসমাজ। বিরহী নামের উৎপত্তির রহস্য হয়ত এ ব্যাখ্যার মধ্যেই নিহিত।
Ref:
যমের রাজিত্তি : ছড়া-ধাঁধা-প্রবাদ বরুণকুমার চক্রবর্তী
পল্লীবৈচিত্রা, দিনেন্দ্রকুমার রায়
দেখা হয় নাই - অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়